বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড (বাংলাদেশ) কর্তৃক প্রণীত বানানরীতি সমূহঃ
ফেসবুকে , ব্লগে ও যে কোন প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ বাংলা লিখতে অনেক কাজে আসবে ...
নোটঃ --" যদি কোন বন্ধুর এত বড় পোস্ট পড়ার ধর্য্য না থাকে অথাবা ব্যস্ততার জন্য পড়তে না পারেন ... তাহলে শেয়ার করে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে পোস্টের লিংক সেইভ রাখুন সময় পেলে একটু একটু করে পড়ে নিবেন ...কারন এখানের কিছু কথা বা শিক্ষা আপনার লাইফে অবশ্যই কাজে লাগবে ...।"

[জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে (১ম খণ্ড, ১৯৭৬, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) বর্ণিত সুপারিশের (অনুচ্ছে ২.২.৫ পাঠ্যপুস্তকের ভাষা ও বানান রীতি ৩৪ পৃঃ) পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তককে অনুসরণের জন্য বানান রীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড বিগত ১৭.৬.৮৪ তারিখে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। বিশেষজ্ঞ কমিটি ২২.৮.৮৪ তারিখে তাঁদের সুপারিশ পেশ করেন। নিম্নে সুপারিশসমূহ এবং অনুসৃতব্য বানানরীতির কিছু উদাহরণ মুদ্রিত হলো।]

পাঠ্যপুস্তকের বানানের জন্য বিশেষভাবে নিম্নলিখিত অভিধানসমূহ অনুসরণ করা হবে :

(ক) বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (স্বরবর্ণ) সম্পাদক- ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক।
(খ) ব্যবহারিক শব্দকোষ : কাজী আবদুল ওদুদ
(গ) চলন্তিকা : রাজশেখর বসু
(ঘ) সংসদ বাংলা অভিধান : শৈলেন্দ্র বিশ্বাস।
(ঙ) পারস্যে আরাবিক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি-ডঃ গোলাম মকসুদ হিলালী

উপরে উল্লিখত অভিধানসমূহে ব্যবহৃত শব্দের প্রথম বানানটি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট অনুসারে সুপারিশকৃত বানান রীতিও সফল হয় নি। তাই ১৯৮৮ সালে পাঠপুস্তক বোর্ড জাতীয় কর্মশিবিরের আয়োজন করে। এই কর্মশিবিরে অংশগ্রহণ করে বিশিষ্ট ভাষা-বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিক্ষা-প্রশাসক, শিক্ষাক্রম-বিশেষজ্ঞ, বাংলা একাডেমী, বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ, ইসলামী ফাউন্ডেশান ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিরা। এই কমিটি তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরর বানানরীতির অক্ষুণ্ণ রেখে অ-তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ধ্বনি বৈশিষ্ট্য অনুসারে বানান রীতি প্রণয়ন করেন। পরে কর্মশিবিরের সুপারিশ অনুসারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অভিন্ন বানানরীতির অনুসরণে পাঠ্য বইয়ের বানান নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় এই বইটি প্রণয়ন করেছিলেন হায়াৎ মামুদ। নিচে এই সুপারিশ তুলে ধরা হলো।

০১. রেফের পর কোথাও ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন-কর্ম, কার্য, শর্ত, সূর্য।
০২. সন্ধিতে প্রথম পদের শেষে ম্‌থাকলে ক-বর্গের পূর্বে ম্ স্থানে ং লেখা হবে। যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত। অন্যান্য ক্ষেত্রে ক, খ, গ, ঘ এবং ক্ষ-র পূর্বে নাসিক্যবর্ণ যুক্ত করার জন্য সর্বত্র ঙ্ লেখা হবে। যেমন-অঙ্ক, আকাঙ্ক্ষা, সঙ্গে ইত্যাদি। প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে অনুস্বার ব্যবহৃত হবে। যেমন : রং। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তিযুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরবর্ণ থাকলে ঙ হবে। যেমন- বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের।
০৩. হস্‌চিহ্ন ও ঊর্ধ্বকমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন- করব, চট, দুজন।
০৪. যে শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর অভিধানসিদ্ধ, সেক্ষেত্রে এবং অ-তৎসম ও বিদেশী শব্দের বানানে শুধু হ্রস্ব স্বর প্রযুক্ত হবে। যেমন- পাখি, বাড়ি, হাতি।
০৫. ক্ষ-বিশিষ্ট সকল শব্দে ক্ষ অক্ষুণ্ণ থাকবে। যেমন-অক্ষয়, ক্ষেত, পক্ষ।
০৬. কয়েকটি স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার হবে। যেমন-গাভী, রানী, হরিণী; কিঙ্করী, পিশাচী, মানবী।
০৭. ভাষা ও জাতির নামের শেষে ই-কার থাকবে। যেমন-ইংরেজি, জাপানি, বাঙালি।
০৮. বিশেষণবাচক ‘আলি’-প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন- সোনালি, রূপালি, বর্ণালি।
০৯. পদাশ্রিত নির্দেশক ‘টি’-তে ই-কার হবে। যেমন-লোকটি।
১০. অর্থভেদ বোঝাবার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বর ব্যবহার করা হবে। যেমন- কি (অব্যয়), কী (সর্বনাম); তৈরি (ক্রিয়া), তৈরী (বিশেষণ), নিচ (নিম্ন অর্থে), নীচ (হীন অর্থে); কুল (বংশ অর্থে), কূল (তীর অর্থে)।
১১. বাংলায় প্রচলিত কৃতঋণ বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতিতে লিখিত হবে। যেমন-কাগজ, জাহাজ, হাসপাতাল ইত্যাদি। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে। যেমন-
(ক) ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত নিম্নলিখিত শব্দের আরবি (যোয়াদ) ও (যাল)-এর জন্য (ইংরেজি z ধ্বনির মত) ব্যবহৃত হবে। যেমন- আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যাকাত, যিকির, যোহর, রমযান, হযরত।
(খ) অনুরূপ শব্দে আরবি (সোয়াদ) ও (সিন)-এর জন্য স এবং (শিন)-এর জন্য শ হবে। যেমন- সালাম, মসজিদ, সালাত, এশা।
(গ) ইংরেজি এবং ইংরেজির মাধ্যমে আগত s ধ্বনির জন্য স ও sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি ধ্বনির জন্য শ এবং st ধ্বনির জন্য ‘স্ট’ যুক্তবর্ণ লেখা হবে।
(ঘ) ইংরেজি বক্র a ধ্বনির জন্য শব্দের প্রারম্ভে এ অপরিহার্য। যেমন-এলকোহল, এসিড।
(ঙ) Christ ও Christian শব্দের বাংলা রূপ হবে খ্রিস্ট ও খ্রিস্টান। এ নিয়মে খ্রিস্টান হবে।
১২. পূর্ববর্তী নিয়মের (ক) থেকে (ঘ) পর্যন্ত বর্ণিত বিধি ব্যাতিক্রম বলে গণ্য হবে। তাছাড়া সংস্কৃত শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে ণত্ব বিধি অনুসরণ করা হবে না। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, নাসিক্যধ্বনি যুক্ত করার জন্য চ- বর্গের পূর্বে কেবল ঞ (যেমন : অঞ্চল, অঞ্জলি, বাঞ্ছা), ট-বর্গের পূর্বে কেবল ণ (যেমন : কাণ্ড, ঘণ্টা) এবং ত-বর্গের পূর্বে কেবল ন (যেমন : তন্তু, পান্থ) লেখা হবে। অনুরূপভাবে, শিসধ্বনি যুক্ত করার জন্য চ-বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল শ (যেমন : নিশ্চয়, নিশ্ছদ্র), ট-বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল ষ (যেমন : কষ্ট, কাষ্ঠ), এবং ত বর্গের অঘোষধ্বনির পূর্বে কেবল স (যেমন : অস্ত্র, আস্থা) ব্যবহৃত হবে।
১৩. পদান্তে বিসর্গ থাকবে না। যেমন-ক্রমশ, প্রধানত, মূলত।

১৪. ক্রিয়াপদের বানানে পদান্তে ও-কার অপরিহার্য নয়। যেমন-করব, হল ইত্যাদি। এত, মত, কোনো প্রভৃতি শব্দে ও-কার আবশ্যক নয়। তবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় ও-কার রাখা যাবে। যেমন- করো, কোরো, বলো, বোলো।
১৫. ব্যঞ্জনবর্ণের ঊ-কার (ূ), ও ঋ-কারের (ৃ) একাধিক রূপ পরিহার করে এই কারগুলো বর্ণের নিচে যুক্ত করা হবে। যেমন- শুভ, রূপ, হৃদয়।
১৬. যুক্তব্যঞ্জন স্বচ্ছ করার জন্য প্রথম বর্ণের ক্ষুদ্রাকারে এবং দ্বিতীয় বর্ণের পূর্ণরূপে লিখতে হবে। যেমন- অঙ্ক, সঙ্গে, স্পষ্ট।
১৭. যেসব যুক্তব্যঞ্জন বাংলা উচ্চারণে নতুন ধ্বনি গ্রহণ করে-যেমন : ক্ষ (ক্ +ষ), জ্ঞ (জ্ +ঞ), হ্ম বা হম (হ্ +ম) সেগুলোর রূপ অক্ষ্ণ্ণ থাকবে। তাছাড়া নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে ঞ্চ (ঞ্ +চ), ঞ্ছ (ঞ্ +ছ), ঞ্জ (ঞ্ +জ), ট্ট (ট্ +ট), ট্র (ট্ +র), ত্ত (ত্ +ত), ত্থ (ত্ +থ), ত্র (ত্ +র), ভ্র (ভ্ +র), হ্ন (হ্ +ন), ষ্ণ (ষ +ণ) ইত্যাদি যুক্তবর্ণের প্রচলিত রূপও অক্ষুণ্ণ রাখা হবে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তব্যঞ্জন গঠনের রূপ ব্যাখ্যা করা হবে।
১৮. সমাস পদ এক সাথে লিখিত হবে। যেমন- জটিলমূলক, বিজ্ঞানসম্মত সংবাদপত্র। অর্থগতভাবে একক হলেও তা একসঙ্গে লেখা হবে। যেমন- ষোলকলা। প্রয়োজনবোধে শব্দের মাঝখানে হাইফেন দেয়া যেতে পারে। যেমন- কিছু-না-কিছু, লজ্জা-শরম, সঙ্গত-পাঠ-নির্ধারণ ইত্যাদি।
১৯. বিশেষণবাচক পদ (গুণ, সংখ্যা বা দূরত্ব ইত্যাদি-বাচক) হলে সেটি আলাদা বসবে। যেমন- এক জন, কত দূর, সুন্দর ছেলে ইত্যাদি।
২০. নঞর্থক শব্দ পৃথকভাবে বসবে। যেমন-ভয়ে নয়, হয় না, আসে নি, হাতে নেই।
২১. হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নামের পরে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে (স), অন্য নবী ও রসূলের নামের পরে বন্ধনীর মধ্যে (আ), সাহাবীদের নামের পরে (রা) এবং বিশিষ্ট মুসলিম ধার্মিক ব্যক্তির নামের পরে (র) লিখতে হবে।
২২. লেখক ও কবি নিজেদের নামের বানান যেভাবে লেখেন বা লিখতেন, সেভাবে লেখা হবে।
২৩. বাংলাদেশের টাকার প্রতীকচিহ্নের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য অঙ্কের বইতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য বইতে তার মূল্য-নির্দেশক সংখ্যার পূর্বে টাকার চিহ্নটি ব্যবহার করা হবে।
২৪. পূর্ববর্ণিত নিয়মাবলীর বহির্ভূত শব্দের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অভিধানগুলোতে প্রদত্ত প্রথম বানান গ্রহণ করা যেতে পারে।
চলন্তিকা : রাজশেখর বসু। ব্যবহারিক শব্দকোষ : কাজী আবদুল ওদুদ। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, দুখণ্ড : জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। বাঙ্‌লা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ-সংকলন: হরেন্দ্রচন্দ্র পাল। পারস্যে-এরাবিক এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি: গোলাম মকসুদ হিলালী।

এরপর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী বাংলা বানান রীতিকে প্রমিত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান এবং সদস্য-সচিব ছিলেন বশীর আলহেলাল। এছাড়া সদস্য হিসাবে ছিলেন- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, জামিল চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস। এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সুপারিশমালা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান রীতিকেও বিবেচনা করেছিল।